সন্ধানী কলমে উঠে আসা ইতিহাসের না বলা কথা

3rd June 2020 বিনোদন
সন্ধানী কলমে উঠে আসা ইতিহাসের না বলা কথা


                   সৌম‍্য বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

    ----------------------------------------------------

ইংরেজিতে embeded journalism  বলে একটি শব্দ চালু আছে । এর মানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের অভিযানের সঙ্গে থেকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রিপোর্ট করা । ২০০৩ সালে মার্কিন বাহিনীর ইরাক আক্রমণের সময়কাল থেকে এই শব্দটির ব্যবহার শুরু হয় । ভ্রাতৃপ্রতিম সাংবাদিক শ্রীমান প্রসেনজিৎ চৌধুরী প্রায় বছর খানেক আগে অামাকে তার রচিত একটি বই উপহার দেয় । বইটির নাম ড্রাগন ভূমির অজানা রহস্য । দীর্ঘদিন ধরেই বইটা নিয়ে দুচারকথা লেখার ইচ্ছা । কিন্তু করোনাক্লান্ত মনে তার সুযোগ হয় নি । অবশেষে মনের কথাটি আনলক হওয়ার সুযোগ পেল । বইটা পড়তে গিয়ে embeded journalism শব্দটার কথা মনে এল এই কারণে যে এই বই কার্যত এক প্রসেনজিতের  embeding প্রয়াস .কিন্তু তা সরাসরিভাবে রণক্ষেত্রে নয় । ইতিহাসের বেশ কিছু অজানা অঞ্চল , যেখানে মহাকালের না বলা অন্ধকার জমা হয়ে আছে সেখানেই এমবেডিং চালিয়েছে প্রসেনজিৎ । বইয়ের পটভূমি চির রহস্যময় ছোট্ট দেশ ভুটান । ট্রাম্প কথিত এই ব‍াটন বা ভুটান স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান দখল করে আছে । হিমালয়ের কোলে চিন ও ভারতের মত দুটি এশীয় দৈত্যের মাঝে যেন শান্তির ধ্বজা তুলে ধরেছে ছোট্ট ভুটান । ভুটান প্রকৃতপক্ষেই প্রসেনজিতের মনোভূমি । সে একটি এমন পরিবারের ছেলে যে পরিবার এই অঞ্চলের রাজনৈতিক বাতাবরণ সম্পর্কে সমধিক পরিচিত। নিছক ঘরে বসে সার্চ ইঞ্জিন  ঘেঁটে লেখা নয় । এই বই তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিবরণ । ভুটানের রাজপরিবারের সঙ্গে প্রসেনজিতের পরিবারের সম্পর্কের কথা সে নিজেই বলেছে ; সেই ভালোবাসা থেকেই এই ছোট্ট নিস্তরঙ্গ দেশে তার হানা । ভারত ভুটান চুক্তির ৭০ বছর পূর্তির খেই ধরে এই ভ্রমণবৃত্তান্তের অবতারণা । কিন্তু এটা নিছক ভ্রমণকাহিনী বলা যাবে না। একজন সাধারণ পর্যটক যেভাবে একটা দেশকে দেখেন  তার থেকে বহুগুণে আলাদা এই কাহিনী । প্রসেনজিৎ ভুটান গেছে । সে এই ছোট্ট দেশকে দেখেছে কৌতূহলী সাংবাদিকের অনুসন্ধিৎসু চোখ দিয়ে । সাধারণভাবে ইতিহাসের বইতে যা আমরা পড়ি এই ট্রাভালগ যেন তার বিপ্রতীপে নিজস্ব এক স্বভূমি রচনা করেছে । যেভাবে এই কাহিনী সে পাঠক দরবারে পেশ করেছে তাতে আমি চমৎকৃত । নন ফিকশনকে ফিকশনের মোড়কে পরিবেশন করা খুব দক্ষ সাংবাদিকতার পরিচায়ক । প্রসেনজিৎ এই কাজটি করেছে সুনিপুণ দক্ষতার সঙ্গে । অনতি অতীতে ২০০৮ সালে  শান্ত ভুটানের বুকে ঘটে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ । এই ঘটনাকে ধরেই সূত্রপাত ঘটেছে প্রসেনজিতের ভুটান অভিযানের । ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসেছে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের কাহিনী। আমি পড়তে পড়তে হারিয়ে গেছি ভুটানের হিমশীতল রাজনৈতিক অাবর্তে। ইতিহাস উঠে এসেছে চোখের সামনে । একট সত্যনির্ভর পলিটিক্যাল থ্রিলারের আঙ্গিকে ঘটনাপ্রবাহ ক্রমশ যেন উন্মোচিত হয়েছে পাঠকের সামনে । প্রসেনজিৎ সেই বিরল সাংবাদিকতার তরুণ প্রতিভূ যেখানে সাংবাদিক তাঁর কলমের গুণে পাঠকের সামনে তৈরি করেন এক চিত্রকল্প । ৫৮ টি অধ্যায়ে ড্রাগনভূমির ন‍ানা অজানা কথা পাঠক দরবারে তুলে ধরেছে প্রসেনজিৎ । প্রসঙ্গত উঠে এসেছে ভুটানের অদূরবর্তী দেশগুলোর কথাও।বিশেষত বর্তমান ভারতের অঙ্গরাজ্য সিকিমের কথা । কাহিনীর বিস্তৃতি ডালপালা মেলেছে কখনও গ্যাংটকের সিকিম প্যালেসে তো কখনও দার্জিলিংয়ের উইন্ডমায়ার হোটেলের সুসজ্জিত বিলাসকক্ষে । ভাবতে অবাক লাগে আমরা ভারতীয়রা হুট করতেই সিকিম বা ভুটানে বেড়াতে চলে যাই । কিন্তু এইসব অঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের বেশীরভাগেরই অজ্ঞতা হিমালয়প্রমাণ । এই অভাবটুকু যেন পূরণ করেছে এই বই। বস্তুত এই অঞ্চলের রাজনৈতিক অভিঘাত যে ভারতের মূলধারার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে কতদূর প্রভাবিত করতে পারে তা বোঝা যাবে ড্রাগনভূমির অজানা রহস্য বইতে চোখ রাখলে । হিমালয়ের কোলে আপাত নিস্তরঙ্গ জীবনের অন্তরালে ঘনিয়ে ওঠা কূটনৈতিক সংঘাতের আবহ ; ক্ষমতালিপ্সার পরম্পরা ; রক্তপাতের ও প্রাণনাশের ভয়াল ভ্রূকুটির মধ্যেও জীবনের স্বাভাবিক ছন্দের জয় সর্বদাই যেন ধ্বনিত হয়ে চলেছে । উত্তমপুরুষে বর্ণিত এই সুদীর্ঘ কাহিনী তে কিছু চরিত্র (যেমন গাড়িচালক প্রধান) কে খুব চেনা লাগে ; যেহেতু নিছক মনগড়া কাহিনী লিখতে বসে নি প্রসেনজিৎ ,তাই প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর কাজটুকু তাকে অসীম ধৈর্য সহকারে করতে হয়েছে । ড্রাগনভূমিতে পা রাখার আগে এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাসকে তন্নিষ্ঠ অধ্যয়নে আত্মস্থ করেছে সে । এই প্রস্তুতিটুকু সমাপ্ত করেই প্রসেনজিৎ ভুটানভূমিতে পা রেখেছে। ফলে তার এই ট্রাভালগের কোথাও কোন ভাষ্য নিছক আরোপিত বলে মনে হয় না ; সাংবাদিকের কৌতূহলী দৃষ্টি কখন যেন রাজনৈতিক গবেষণার দীপ্র শিখায় উদ্ভাসিত হয়েছে । বহু ছবি , গুরুত্বপূর্ণ দিনলিপির পাতার ফটোকপির সংযোজন বিবরণের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে । এই অনুকরণযোগ্য কাজটির জন্য কোন প্রশংসাই প্রসেনজিতের জন্য কম মনে হবে । এইরকম কাজ আরও হলে তা বাংলা সাংবাদিকতার পক্ষে খুবই শুভ লক্ষ্মণ । সুমুদ্রিত বইটি প্রকাশ করেছে সহজপাঠ ; অতীশ চক্রবর্তীর কৃত সুন্দর  প্রচ্ছদ বইটির আকর্ষণ বহুগুণ বাড়িয়েছে । ২২৬ পৃষ্ঠার বইটির দাম ২৭৫ টাকা ; প্রসেনজিতের এই কাজ বাংলার পাঠক মহলে যথোপযুক্ত  আদৃত হবে এ বিশ্বাস আমার আছে ।





Others News

ফিরে এসো অপু - আকুল প্রার্থনায় আপামর বাঙালী

ফিরে এসো অপু - আকুল প্রার্থনায় আপামর বাঙালী


                    সৌম‍্য ঋষি 

----------------------------------------

আপনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, গভীর রাতে বা ভোরবেলা ফোন বাজলেই চমকে ওঠেন। আবার কারও মৃত্যু সংবাদ এল কি?  এবার কার পালা! 
রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, "আমি পরাণের সাথে খেলিব আজিকে মরণখেলা নিশীথবেলা।" তেমনই আপনার কন্ঠে -" মৃত্যু আয় তিনপাত্তি খেলি"- অমর হয়ে থাকবে। যদিও আপনি লেখেননি, তবু যেন এটা আপনার। আপনার মনের কথাগুলি যেন অনেকদিন বাদে বললেন। আপনার সাদাকালো সিনেমা দেখে যেই প্রজন্ম বড় হয়েছেন তাদের মনে সবসময় আপনাকে আর উত্তম কুমারকে নিয়ে একটা তুলনা চলত। কিন্তু তারাও আপনার অভিনয়ের, কন্ঠের ভক্ত। অথচ বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের প্রথম পছন্দ ছিলেন আপনি।  আমরা যারা চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের দিকে চলেছি এবং প্রতিনিয়ত আপনার নতুন নতুন কাজ দেখছি, তারা আপনার আকুল ভক্ত। ছোট ছোট বাজেটের ছবি, আর তাতে আপনার উপস্থিতি ছবিটিকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যায়।  আমরা অপুকে চিনি, ফেলুদাকে চিনি, জীবনে কি পাব না গানের সাথে নৃত্যরত সেই অভিনেতাকে যেমন চিনি, তেমন চিনি সেই অগ্রদানী ব্রাহ্মণকে - যার অসহায়তা চোখের জল ধরে রাখতে দেয় না - আবার কুন্তল কেও চিনি, পোস্তর দাদুকে চিনি, বেলাশেষের সেই বৃদ্ধকে চিনি, ধর্ষিতা নাতনির হয়ে বদলা নেওয়া ইঞ্জিনিয়ার  দাদুকে চিনি। পর্দায় আপনার সৌম্যদর্শন চেহারা, বিরামহীন এই কর্মজীবন শুধু আমাদের নয়, আমাদের পরের প্রজন্মকেও আপনার ডাই হার্ট ফ্যান করে তুলেছে। আজ মৃত্যু আপনার কাছে একটি আবশ্যিক ঘটনার মতো। রেখাপাত করার মতো নয়।  কারণ আপনি লিজেন্ড।  আমরা আপনাকে চিনি আপনার কাজ দিয়ে। যা আপনাকে চিরজীবী করবে। ব্যাক্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কেমন থাকেন, তাঁর নিজস্ব দুঃখ সুখ,তাঁর জীবনটা কি আমাদের মতোই সাধারণ না রূপকথার মতো - জানি না কিছুই। আপনি এই অসাধ্যসাধনটি করতে পেরেছেন। আমরা ঋদ্ধ হয়েছি আপনার কাজে। প্রণম্য আপনি। সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন। না হয় আপাতত কাজ নাই করলেন। তবু জানব আছেন। আর যদি মৃত্যু আপনাকে ডেকে নেয়, তার কারণ অন্য হোক। করোনায় মরণ আপনার জন্য কাম্য না। কক্ষোনো না কক্ষোনো না ----

ছবি : সংগৃহিত